আন্দুল রাজ বাড়ির ইতিহাস ও দুর্গা পূজা, আন্দুল, হাওড়া
শ্যামল কুমার ঘোষ
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : আঠারো শতকের মধ্যভাগে হুগলি জেলার আন্দুল ছিল একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। কর পদবীর কায়স্থ পরিবারের রামচরণ বা রামচাঁদ করের ( রায় ) ফার্সি ও আরবি ভাষায় খুবই দখল ছিল। আনুমানিক ১৭৫০ খ্রীঃ মাসিক মাত্র ২০ টাকায় তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হুগলির দপ্তরে উকিল পদে যোগ দেন। তীক্ষ্নবুদ্ধিসম্পন্ন ও পরিশ্রমী রামচরণ নিজের কর্মদক্ষতায় রাজধানী মুর্শিদাবাদে কোম্পানির দেওয়ানের সহকারী হিসাবে মাসিক ৬০ টাকা বেতনে যোগ দেন। মুন্সী নবকৃষ্ণের ( শোভাবাজারের মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব ) মত তিনিও রবার্ট ক্লাইভ ও ওয়ারেন হেস্টিংসের বিশ্বাসভাজন ছিলেন। তিনি আন্দুল অঞ্চলের জোড়হাট গ্রামটি পেয়ে জমিদারি শুরু করেন। ১৭৫৭ খ্রীঃ পলাশীর যুদ্ধের পর পরাজিত ও পলাতক সিরাজ-উদ্-দৌলার প্রাসাদে রক্ষিত প্রায় আট কোটি টাকার মুদ্রা-হীরা-জহরত লুট করার সময় তিনি, নবকৃষ্ণ ও আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন। ( অনেকে মনে করেন যে রামচরণ সিরাজের প্রাসাদ থেকে লুন্ঠিত টাকা ও জহরত নদী পথে আন্দুলে নিয়ে এসেছিলেন, কেননা তিনি যখন মারা যান তখন তাঁর কাছে ১৬ লক্ষ টাকা আয়ের জমিদারি ও ২০ লক্ষ টাকার জহরত বর্তমান ছিল। ) ১৭৬৫ খ্রীঃ ইংরেজ বণিকদের বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভের পর তিনি ক্লাইভের দেওয়ান পদে নিযুক্ত হন। ফলে তাঁর প্রভাব, প্রতিপত্তি ও ধন-সম্পত্তি যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। লর্ড ক্লাইভের ইচ্ছায় তিনি 'রাজা' উপাধি পান। মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহআলমের ( ১৭৫৯-১৮০৬ ) কাছে আর্জি দিয়ে রামচরণ তাঁর প্রাপ্য 'রাজা' উপাধি নিজ পুত্র রামলোচন রায়কে পাইয়ে দেন ২ জানুয়ারি, ১৭৬৬ খ্রীঃ।
রাজা রামলোচন রায় : রাজা রামলোচন রায় পিতার জীবিত অবস্থায় জমিদারির কার্যভার গ্রহণ করেন। বিদ্যোৎসাহী রাজা রামলোচন আন্দুল ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় টোল, চতুস্পাঠী ও আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। কোম্পানির গভর্নর ভান্সিটার্ট তাঁকে তাঁর দেওয়ান হিসাবে নিযুক্ত করেন। শেষ জীবনে তিনি কলকাতার পাথরিয়াঘাটার বাসভবনে থাকতেন। মহারাজ নন্দকুমারের জালিয়াতির বিচারের সময় তিনি ছিলেন সরকার পক্ষের প্রধান সাক্ষীদের অন্যতম এবং এই মামলায় তিনি হেস্টিংসকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। কালীঘাটের মন্দিরের সামনে নাটমন্দির তিনি তৈরি করেছেলেন। আন্দুলের প্রথম রাজবাড়ি তাঁর তৈরি। তাঁর তৈরি দুর্গাদালানে প্রথম দুর্গাপূজা শুরু হয় ১৭৭০ খ্রীঃ। ১৭৭৭ খ্রীঃ তাঁর মৃত্যু হয়।
রাজা কাশীনাথ রায় : রামলোচনের জ্যেষ্ঠ্য পুত্র কাশীনাথ রায়
( ১৭৬৭- ১৮৬০ খ্রীঃ ) মাত্র দশ বছর বয়সে আন্দুল জমিদারির উত্তরাধিকারী হন। আন্দুলের অন্নপূর্ণার মন্দির ও সংলগ্ন চোদ্দটি শিব মন্দির তিনিই নির্মাণ করেছিলেন।
রাজা রাজনারায়ণ রায় : রাজা কাশীনাথ রায় যখন মারা যান তখন তাঁর একমাত্র পুত্র রাজনারায়ণের বয়স মাত্র চার বছর। স্বভাবতই 'কোর্ট অফ্ ওয়ার্ডস' জমিদারি পরিচালনার ভার নেন। তিনি হিন্দু কলেজের ছাত্র ছিলেন। ডিরোজিওর 'ইয়ং-বেঙ্গল' আন্দোলনের তিনি অন্যতম সদস্য ছিলেন। সংস্কৃত ভাষায় তাঁর ব্যুৎপত্তি ছিল। তাঁর আমলে আন্দুল সংস্কৃত সাহিত্য-চর্চার এক বিশেষ কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। ভারতের বড়লাট লর্ড অকল্যান্ড ১৮৩৬ খ্রীঃ তাঁকে 'রাজা বাহাদুর' উপাধি দেন এবং একটি রত্নখচিত তরবারি উপহার দেন। আন্দুলের বিরাট রাজপ্রাসাদটি তাঁর আমলে তৈরি। যদিও তাঁর পুত্র বিজয়কেশব রাজপ্রাসাদের বাকি কিছু অংশ নির্মাণ করেন। প্রায় ষাট ফুটের বেশি উঁচু তিনতলা বিশিষ্ট বিরাট রাজপ্রাসাদটির সামনের দিকের মাঝখানে রয়েছে দশটি ডোরিক্ স্থাপত্যের অনুকরণে তৈরি প্রায় পঞ্চাশ ফুট উঁচু স্তম্ভ যা সারা বাংলার একমাত্র এই প্রাসাদটিতেই দেখা যায়।
রাজা বিজয়কেশব রায় : ১৮৫৯ খ্রীঃ রাজা রাজনারায়ণের মৃত্যুর সময়ে পুত্র বিজয়কেশবের বয়স মাত্র ১৩ বছর। বিজয়কেশবের দুই পত্নী। কিন্তু তাঁদের কোন পুত্র সন্তান ছিল না। তিনি তন্ত্র সাধনায় শেষ জীবন অতিবাহিত করেন। মারা যান ১৮৭৯ খ্রীঃ। তাঁর দুই বিধবা রানি দুর্গাসুন্দরী ও নবদুর্গা দুটি দত্তক নেন। কিন্তু আদালতের রায়ে দত্তক গ্রহণ অবৈধ সাব্যস্ত হয়। রাজা কাশীনাথের কন্যা ত্রিপুরাসুন্দরীর বিবাহ হয় কৃষ্ণনগর নিবাসী কালিপদ মিত্রের সঙ্গে। আদালতের আর একটি আদেশে ত্রিপুরাসুন্দরীর পুত্র ক্ষেত্রকৃষ্ণ মিত্র আন্দুল জমিদারির মালিকানা পান। এইভাবে আন্দুলে 'রায়' রাজপরিবারের অবসান হয় ও 'মিত্র' রাজপরিবারের সূচনা হয়।
ক্ষেত্রকৃষ্ণ মিত্র আন্দুল ও অন্যান্য স্থানের বেশ কয়েকটি দেবালয়, রাস্তা-ঘাট, সেতু, স্কুল, হাসপাতাল প্রভৃতি জনহিতকর কাজে সাধ্যমত দান করেছিলেন। ছোট লাট এ. ম্যাকেঞ্জি তাঁকে 'সার্টিফিকেট অফ অনার' প্রদান করেন। স্থানীয় লোকেরা তাঁকে 'রাজা' উপাধি দিয়েছিলেন। ১৯০৭ খ্রীঃ ৮৫ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
এখন আন্দুল রাজবাড়িতে নতুন তৈরি দুর্গাদালানে প্রতি বছর দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। ( সঙ্গের ছবিগুলো ২০১৮ সালের ষষ্ঠীর দিন তোলা। )
আন্দুল রাজবাড়ি - ১ |
আন্দুল রাজবাড়ি - ২ |
খিলানের উপরের কাজ |
নতুন ঠাকুরদালান |
প্রতিমা - ১ |
প্রতিমা - ২ |
প্রতিমা - ৩ |
আন্দুল রাজবাড়ি যেতে হলে হাওড়া স্টেশন থেকে আন্দুলের বাসে উঠে আন্দুল বাজারে নামুন। সেখান থেকে টোটোতে বা হেঁটে আন্দুল রাজবাড়ি।
******
সহায়ক গ্রন্থ :
১) বাংলার খেতাবী রাজ-রাজড়া : বিমল চন্দ্র দত্ত
১) বাংলার খেতাবী রাজ-রাজড়া : বিমল চন্দ্র দত্ত
******
খুব সুন্দর। আপনার কাজ অসাধারণ
উত্তরমুছুনধন্যবাদ।
মুছুন