বৃহস্পতিবার, ২ আগস্ট, ২০১৮

Shobhabazar Rajbari ( Kolkata ) History and Durgapuja


শোভাবাজার  রাজবাড়ির  ইতিহাস  
ও  দুর্গা  পূজা,  কলকাতা   


শ্যামল  কুমার  ঘোষ 


            কলকাতার  বারোয়ারি  পুজোতে  'কর্পোরেট'  হস্তক্ষেপের  পর  দুর্গাপুজোতে  এল  এক  আমূল  পরিবর্তন।  ক্লাবগুলোর  মধ্যে  শুরু  হল  সুস্থ  প্রতিযোগিতা।  শুরু  হল  থিমের  পুজো।  

            প্রতি  বছর  ক্লাবগুলোর  নতুন  নতুন  থিম  দেখতে  রাস্তায়  মানুষের  ঢল  নামে।  এখন  তো  মহালয়া  থেকেই  শুরু  হয়  ঠাকুর  দেখা।  এই  সব  পুজোতে  পুজোটা  হয়  গৌণ।  কিন্তু  এই বারোয়ারি  পুজোর  বাইরে  আর  এক  রকম  পুজো  হয় কলকাতার  বনেদি  বাড়িগুলোর  থামওয়ালা  ঠাকুরদালানে।  এই  সব  বাড়ির পুজো  কোনটা  একশ  বছরের  পুরানো।  কোনটা  আবার  দু-তিনশ,  এমন  কি  চারশ  বছরেরও  বেশি  পুরানো।  এই  সব  বাড়ির  পুজোর  সঙ্গে  জড়িয়ে  আছে  কিংবদন্তি,  ইতিহাস আর  পরম্পরা।  এখন  হয়তো  আগের  মত  সেই  চোখ-ধাঁধানো জৌলুস  নেই,  ঠিকই।  কিন্তু  এই  সব  বাড়িতে  পুজো  হয় অতীতের  পরম্পরা  মেনে,  নিষ্ঠা  সহকারে।  বাড়ির  বেশির  ভাগ  সভ্য-সভ্যারা  কলকাতার  অন্যত্র,  বাংলার  বাইরে  এমন  কি বিদেশেও  থাকেন।  তাঁরা  পুজো  উপলক্ষ্যে  এক  সঙ্গে  মিলিত হন।  এই  সব  বাড়ির  সাবেকি  পুজোতে  উপস্থিত  হলে  আপনি হয়তো  পৌঁছে  যাবেন  সুদূর  অতীতে।  আজ  শোভাবাজার  রাজবাড়ি।       

শোভাবাজার রাজবাড়ি / Shobhabazar Rajbari :  
( শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনের কাছে )

সংক্ষিপ্ত  ইতিহাস :  শোভাবাজার  নামের  উৎস  নিয়ে  মতভেদ  আছে। এক  মতে, বর্তমান  শোভাবাজার  অঞ্চলটির  আগের  নাম  ছিল  'পাবনার  বাগান'।  দুর্গাপূজা  বা  অন্যান্য  আনন্দোৎসবে  রাজবাড়ি  অপরূপ  আলোতে  সাজানো  হওয়াতে  'শোভা'  বেড়ে  যেত  ও  প্রচুর  লোক  সমাগমে  'বাজারে'  পরিণত  হত।  তার  থেকে  নাম  হয়  শোভাবাজার।  অন্য  মতে,  এখানে  আগে  শোভারাম  বসাকের  বাগান  বাড়ি  ছিল।  এই  শোভারামের  নাম  থেকে  হয়  শোভাবাজার।   

            শোভাবাজার  রাজবাড়ির  প্রতিষ্ঠাতা  মহারাজা  নবকৃষ্ণ  দেব।  তাঁর  পিতা  রামচরণ  দেব  ছিলেন  কটকের  দেওয়ান।  নবকৃষ্ণ  ছিলেন  রামচরণের  তিন  পুত্রের  মধ্যে  কনিষ্ট।  অল্প  বয়সেই  তিনি  ফার্সি  ভাষায়  পারদর্শী  হয়ে  ওঠেন।  ইংরাজিও  শিখেছিলেন।  তিনি  ছিলেন  ওয়ারেন  হেস্টিংসের  ফার্সি  ভাষার  গুরু।  তাঁর  কাজে  সন্তুষ্ট  হয়ে  ইস্ট  ইন্ডিয়া  কোম্পানি  তাঁকে  মুন্সি  পদে  নিয়োগ  করেন।  এই  কাজে  তাঁর  দক্ষতা  দেখে  কর্নেল  ক্লাইভ  তাঁকে  বহু  গুরুত্বপূর্ণ  কাজ  দেন  যা  স্বাধীন  সরকারের  বিদেশ  সচিবের  কাজের  সমতুল্য।  সিরাজ-উদ-দৌলা  যখন  কলকাতা  আক্রমণের  জন্য  হালসিবাগে  ছাউনি  ফেলেন  তখন  বহু  উপঢৌকন  দিয়ে  নবকৃষ্ণকে  তাঁর  কাছে  পাঠানো  হয়।  মীর  জাফর  ও  কর্নেল  ক্লাইভের  মধ্যে  ষড়যন্ত্রেরও  মাধ্যম  ছিলেন  নবকৃষ্ণ।

             রাজা  নবকৃষ্ণ  ছিলেন  বিদ্যোৎসাহী।  তিনি  বিক্রমাদিত্যের  অনুকরণে  'নবরত্ন'  সভা  স্থাপন  করেছিলেন।  তাঁর  সভার  অলংকার  ছিলেন  জগদ্বিখ্যাত  জগন্নাথ  তর্কপঞ্চানন,  মহাকবি  বাণেশ্বর  বিদ্যালঙ্কার,  নবদ্বীপের  প্রধান  নৈয়ায়িক  শঙ্কর  তর্কবাগীশ,  বলরাম  তর্কভূষণ,  কামদেব  বিদ্যাবাচষ্পতি,  গদাধর,  নৈয়ায়িক  শিশুরাম  তর্কপঞ্চানন,  স্মার্ত  কৃপারাম  তর্কবাগীশ  ও  শান্তিপুরের  রাধামোহন  বিদ্যাবাচষ্পতি  গোস্বামী  ভট্টাচার্য।  এঁরা  সকলেই  সেই  সময়ে  নিজ  নিজ  ক্ষেত্রে  দিকপাল  ছিলেন।  দুর্লভ  সংস্কৃত  ও  ফার্সী  পুঁথি  সংগ্রহে  তিনি  উদারহস্তে  অর্থ  ব্যয়  করতেন।  বেহালা  থেকে  কুলপি  পর্যন্ত  তিনি  একটি  রাস্তা  নির্মাণ  করে  দিয়েছিলেন।  পুরাতন  ও  নতুন  রাজবাড়ির  মধ্যে  তিনি  আর  একটি  রাস্তা  তৈরি  করেছিলেন  যার  বর্তমান  নাম  রাজা  নবকৃষ্ণ  স্ট্রিট।  পুত্র  সন্তান  না  থাকায়  মহারাজা  তাঁর  বড়ভাই  রামসুন্দর  দেবের  পুত্র  গোপীমোহনকে  দত্তক  নেন।  পরে  তাঁর  নিজের  একটি  পুত্র  হয়।  ইনিই  রাজা  রাজকৃষ্ণ।  নবকৃষ্ণের  মৃত্যুর  পর  সুপ্রিম  কোর্টের  মামলার  রায়ে  তাঁর  দুই  পুত্র  গোপীমোহন  ও  রাজকৃষ্ণ  নবকৃষ্ণের  সম্পত্তির  সমান  সমান  অংশীদার  হন।  রাজা  নবকৃষ্ণ  স্ট্রীটের  উত্তর  দিকে  অবস্থিত  পুরাতন  রাজবাড়ি ( ৩৩, রাজা  নবকৃষ্ণ  স্ট্রিট )  পান  গোপীমোহন  ও  দক্ষিণ  দিকে  অবস্থিত  নতুন  রাজবাড়ি ( ৩৬, রাজা  নবকৃষ্ণ  স্ট্রিট )  পান  রাজকৃষ্ণ।  গোপীমোহনের  বংশধরগণ  হলেন  বড়তরফ  আর  রাজকৃষ্ণের  বংশধরগণ  হলেন  ছোটতরফ।  
     
            ১৭৫৭ সালে  পলাশী  যুদ্ধের  পর  নবকৃষ্ণ  পুরানো  রাজবাড়িতে  দুর্গোৎসবের  সূচনা  করেন।  সে  বছর  পুজোয়  বিশেষ  অতিথি  ছিলেন  স্বয়ং  লর্ড  ক্লাইভ।  অনেক  পরে  ১৭৯০-এ  নতুন  রাজবাড়িতেও  দুর্গা  পূজা   শুরু  হয়।  

  ৩৩, রাজা  নবকৃষ্ণ  স্ট্রিটের  বাড়ি  ও  দুর্গা  প্রতিমার  ছবি ( ২০১৫ সালে  তোলা ) : 


রাজবাড়ি  ও  ঠাকুরদালান

প্রতিমা - ১

প্রতিমা - ২


৩৬, রাজা  নবকৃষ্ণ  স্ট্রিটের 
 ঠাকুর  দালান  ও  প্রতিমার ছবি ( ২০১৫ সালে  তোলা ) :


ঠাকুর  দালানের  একাংশ ( বাহির )

ঠাকুর  দালানের  একাংশ ( ভিতর )

প্রতিমা 


সহায়ক  গ্রন্থ :
                   ১)  কলকাতার  বাবু  বৃত্তান্ত :  লোকনাথ  ঘোষ
                                                               
                                                               *******

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন