শনিবার, ৪ আগস্ট, ২০১৮

Rani Rashmoni Bari History and Durga Puja, Kolkata



 রানি  রাসমণি  বাড়ির  ইতিহাস  ও  দুর্গা  পূজা  


শ্যামল  কুমার  ঘোষ 


            কলকাতার  বারোয়ারি  পুজোতে  'কর্পোরেট'  হস্তক্ষেপের  পর  দুর্গাপুজোতে  এল  এক  আমূল  পরিবর্তন।  ক্লাবগুলোর  মধ্যে  শুরু  হল  সুস্থ  প্রতিযোগিতা।  শুরু  হল  থিমের  পুজো।  

            প্রতি  বছর  ক্লাবগুলোর  নতুন  নতুন  থিম  দেখতে  রাস্তায়  মানুষের  ঢল  নামে।  এখন  তো  মহালয়া  থেকেই  শুরু  হয়  ঠাকুর  দেখা।  এই  সব  পুজোতে  পুজোটা  হয়  গৌণ।  কিন্তু  এই বারোয়ারি  পুজোর  বাইরে  আর  এক  রকম  পুজো  হয় কলকাতার  বনেদি  বাড়িগুলোর  থামওয়ালা  ঠাকুরদালানে।  এই  সব  বাড়ির পুজো  কোনটা  একশ  বছরের  পুরানো।  কোনটা  আবার  দু-তিনশ,  এমন  কি  চারশ  বছরেরও  বেশি  পুরানো।  এই  সব  বাড়ির  পুজোর  সঙ্গে  জড়িয়ে  আছে  কিংবদন্তি,  ইতিহাস আর  পরম্পরা।  এখন  হয়তো  আগের  মত  সেই  চোখ-ধাঁধানো জৌলুস  নেই,  ঠিকই।  কিন্তু  এই  সব  বাড়িতে  পুজো  হয় অতীতের  পরম্পরা  মেনে,  নিষ্ঠা  সহকারে।  বাড়ির  বেশির  ভাগ  সভ্য-সভ্যারা  কলকাতার  অন্যত্র,  বাংলার  বাইরে  এমন  কি বিদেশেও  থাকেন।  তাঁরা  পুজো  উপলক্ষ্যে  এক  সঙ্গে  মিলিত হন।  এই  সব  বাড়ির  সাবেকি  পুজোতে  উপস্থিত  হলে  আপনি হয়তো  পৌঁছে  যাবেন  সুদূর  অতীতে।  আজ  রানি  রাসমণির  বাড়ি। 

রানি  রাসমণির  বাড়ি :  
এস. এন. ব্যানার্জী  রোডে  অবস্থিত। 
( Corporation  Building - এর  কাছে। ) 

সংক্ষিপ্ত  ইতিহাস :  ১৭৯৩  খ্রীষ্টাব্দে  রানি  রাসমণি  উত্তর  ২৪  পরগণার  জেলার  অন্তর্গত  হালিশহরের  নিকট  কোনা  গ্রামে  এক  গরীব  কৃষিজীবী-কৈবর্ত  পরিবারে  জন্ম  গ্রহণ  করেন।  তাঁর  বাবার   নাম   হরেকৃষ্ণ  দাস।  মা  রামপ্রিয়া।  মাত্র  আট  বছর  বয়সে   তাঁর  মা  মারা  যান।  কলকাতা  নিবাসী  জমিদার-ব্যবসায়ী  প্রীতরাম  মাড়  ( দাস )  ব্যবসার  কাজে  হালিশহরে  যান।  তিনি  একটি  সুন্দরী  পাত্রী  খুঁজছিলেন।  রাসমণির  রূপ  ছিল  দেখবার  মতো,  তাছাড়া  স্বজাতি।  এগার  বছর  বয়সে  প্রীতরামের  কনিষ্ঠ  পুত্র  রাজচন্দ্রের  সঙ্গে  এক  রাতে  তাঁর  শুভবিবাহ  সম্পন্ন  হল। ( প্রীতরাম  নুন,  পাট,  বাঁশ  ইত্যাদি  অনেক  রকমের  ব্যবসা  করলেও  প্রথম  জীবনে  তিনি  বাঁশের  ব্যবসা  করতেন।  গ্রাম  থেকে  বাঁশের  গাদা  জলে  ভাসিয়ে  কলকাতায়  আনতেন।  এই  ভাসমান  বাঁশরাশিকে  গ্রাম্য  ভাষায়  'মাড়'  বলে।  এর  থেকেই  তিনি  'মাড়'  উপাধি  পান। )  রানি  রাসমণি  ছিলেন  রামচন্দ্রের  তৃতীয়  পক্ষের  স্ত্রী।  রাজচন্দ্রের  দুই  স্ত্রী  মারা  গেলে  তিনি  রাসমণিকে  বিয়ে  করেন।  প্রীতরামের  দুই  পুত্র -  হরচন্দ্র  ও  রাজচন্দ্র।  প্রীতরাম  বেঁচে  থাকতেই  হরচন্দ্রের  মৃত্যু  হয়।  তাই  প্রীতরামের  মৃত্যুর  পর  রাজচন্দ্র  সমস্ত  সম্পত্তির  অধিকারী  হন।  রাসমণির  প্রথম  অবদান  কলকাতার  গঙ্গাতীরের  বাবুঘাট।  তাঁর  অনুরোধে  রাজচন্দ্র  এই  ঘাটটি  বাঁধিয়ে  দিয়ে  জানবাজার  থেকে  ঘাট  পর্যন্ত  রাস্তা  তৈরী  করে  দেন।  রাস্তার  নাম  হয়  বাবু  রোড।  রাজচন্দ্র  ছিলেন  উদারপন্থী,  বিদ্যোৎসাহী।  সতীদাহ  প্রথা  রোধে  রামমোহনের  আন্দোলনের  তিনি  সঙ্গী  ছিলেন।  হিন্দু  কলেজ  প্রতিষ্ঠার  সময়ও  তিনি  সাহায্য  করেন।  রাজচন্দ্রের  মৃত্যুর  পর  তাঁর  সমাজসেবামূলক  কাজকে  আরও  এগিয়ে  নিয়ে  যান  রাসমণি।           

             রাসমণি  ছিলেন  খুবই  তেজস্বিনী  মহিলা।  রাসমণির  বাড়ি  থেকে  গঙ্গাতীর  পর্যন্ত  রাস্তা  দুর্গাপুজোর  সময়  ঢাকের  বাদ্যে  ও  আনন্দ  কোলাহলে  মুখরিত  হোত।  ইংরেজের  পুলিশ  এই  আনন্দোৎসব  বন্ধ  করতে  উদ্যত  হলে  রাসমণি  সেই  রাস্তা  দিয়ে  ইংরেজদের  চলাচল  বন্ধ  করে  দিলেন।  কারণ  সেই  রাস্তাটি  তিনিই  তৈরী  করে  ছিলেন।  তখন  বাধ্য  হয়ে  পুলিশ  তাদের  নিষেধাজ্ঞা  তুলে  নেয়।  পূর্বে  গঙ্গায়  মাছ  ধরতে  কোন  কর  দিতে  হোত  না।  কিন্তু  সরকার  জেলেদের  উপর  জলকর  বসালে  গরিব  জেলেরা  খুবই  অসুবিধায়  পড়লেন।  তাঁরা  রাসমণিকে  এসে  ধরলেন।  রাসমণি  কাশীপুর  থেকে  মেটিয়াবুরুজ  পর্যন্ত  গঙ্গা  বার্ষিক  ১০  হাজার  টাকায়  ইজারা  নিলেন  এবং  কর্মচারীদের  নির্দেশ  দিলেন,  বয়ায়  বয়ায়  নদীতে  যাতায়াতের  পথ  বন্ধ  করে  দিতে  যাতে  কোন  জাহাজ,  স্টিমার  বা  নৌকা  যাতায়াত  করতে  না  পারে।  পুলিশ  কৈফিয়ত  তলব  করলে  রাসমণি  উত্তর  দিলেন,  জাহাজ  ইত্যাদি  চলাচল  করলে  তাঁর  মাছ  নষ্ট  হয়।  পুলিশ  জোর  করে  পথ  খুলে  দিলে  তিনি  মামলা  জুড়ে  দেন।  এ  ব্যাপারে  তাঁর  অনেক  টাকা  খরচ  হলেও  শেষ  পর্যন্ত  সরকার  জলকর  তুলে  দেন।  যশোহরের  অন্তর্গত  মকিমপুরে তাঁদের   একটি  জমিদারি  ছিল।  সেখানে  নীলকর  সাহেবরা  নীলচাষিদের  উপর  খুবই  অত্যাচার  করতেন।  তার  বিরুদ্ধে  প্রজারা  বিদ্রোহ  করলে  রাসমণি  প্রজাদের  পক্ষে  সেখানে  লাঠিয়াল  পাঠিয়ে  নীলকর  সাহেবদের  অত্যাচার  থেকে  নিজের  প্রজাবর্গকে  রক্ষা  করেন।  একবার  তিনি  বারাণসী  তীর্থ  দর্শনের  মনস্থ  করলেন।  তখন  কাশী,  গয়া, বৃন্দাবন  ইত্যাদি  তীর্থ  ভ্রমণ  ছিল  দুরূহ  ব্যাপার।  ২৫ টা  বজরায়  ছ'  মাসের  উপযোগী  রসদ  মজুত  করা হল।  যাওয়ার  দিনক্ষণ  পাকা।  এমন  সময়  বাংলায়  দুর্ভিক্ষ  দেখা  দিল।  তিনি  কাশী  যাওয়ার  সংকল্প  পরিত্যাগ  করে  অনাহারক্লিষ্ট  নরনারীগণকে  আশ্রয়  দিলেন  ও  খাদ্যের  ব্যবস্থা  করলেন।  অন্য  মতে,  তিনি  স্বপ্নে  দেখেন,  অন্নপূর্ণা-বিশ্বেশ্বর  তাঁকে  কাশীতে  না  গিয়ে  দরিদ্রনারায়ণের  সেবা  করতে  আদেশ  দেন।  তাঁর  সবচেয়ে  উল্লেখযোগ্য  কাজ,  দক্ষিণেশ্বরের  কালীমন্দির  প্রতিষ্ঠা  ও  সেখানে  শ্রীরামকৃষ্ণকে  পূজারী  নিয়োগ  করা।  এই  মন্দির  প্রতিষ্ঠা  ও  নির্মাণ  করতে  তাঁর  ব্যয়  হয়  ৯  লক্ষ  টাকা।  নিত্যসেবার  জন্য  তিনি  ৫  লক্ষ  মূল্যের  সম্পত্তি  দেবত্তর  করেন।          

             রাজচন্দ্র-রাসমণির  কোন  পুত্রসন্তান  ছিল  না।  তাঁর  ছিল  চার  কন্যা -  পদ্মমণি,  কুমারী,  করুণাময়ী  ও  জগদম্বা।  পদ্মমণির  বিয়ে  হয়  সিঁথি  নিবাসী  রামচন্দ্র  দাসের  সঙ্গে।  করুণাময়ীর  বিয়ে  হয়  মথুর  মোহন  বিশ্বাসের  সঙ্গে।  বিয়ের  দু  বছরের  মধ্যে  করুণাময়ীর  মৃত্যু  হলে  রাসমণি  তাঁর  ছোট  মেয়ে  জগদম্বার  সঙ্গে  মথুরবাবুর  বিয়ে  দেন।  এখানে  উল্লেখ্য,  জগদম্বা  দেবী  উত্তর  ২৪  পরগণার  ব্যারাকপুরের  তালপুকুরে  শিবশক্তি  অন্নপূর্ণার  এক  নবরত্ন  মন্দির  প্রতিষ্ঠা  করেন  যা  দেখতে  হুবহু   দক্ষিণেশ্বরের  কালীমন্দিরের  অনুরূপ।  

              যদিও  রানি  রাসমণির  নামে  এ  বাড়ির  পুজো  পরিচিত  তবে  পুজো  শুরু  হয়  প্রীতরামের  আমলে।  তাঁর  মৃত্যুর  পর  তাঁর  পুত্র  রাজচন্দ্র  পুজো  করেন।  রাজচন্দ্রের  মৃত্যুর  পর  পুজোর  ভার  নেন  রানি  রাসমণি।  পরে  এখানে  আরও  দুটি  পুজো  শুরু  হয়।    প্রথম  পুজোটি  শুরু  হয়  ১৩ নং  রানি  রাসমণি  রোডে  অবস্থিত  ঠাকুর  দালানে।

             মথুর  মোহন  বিশ্বাসের  ছেলে  ত্রৈলোক্যনাথ  বিশ্বাস।  ত্রৈলোক্যেনাথের  চার  ছেলে।   শ্রীগোপাল,  মোহনগোপাল,  ব্রজগোপাল  ও  নিত্যগোপাল।  ত্রৈলোক্যনাথ  তাঁর  সেজ  ছেলে  ব্রজগোপালকে  ১৩ নং  রানি  রাসমণি  রোডের  বাড়িটি  দিয়ে  যান।  ব্রজগোপালের  স্ত্রী  সিন্ধুবালা  দাসী।  ব্রজগোপাল-সিন্ধুবালার  দুই  মেয়ে।  লাবণ্যলতা  ও  বিদ্যুৎলতা।  বিদ্যুৎলতার  শ্বশুরবাড়িতে  অপঘাতে  মৃত্যু  হয়।  লাবণ্যলতার  স্বামী  বিজয়  কৃষ্ণ  হাজরা।  তাঁদের  আট   ছেলে।  এখন  হাজরা  বংশ  এই  বাড়ির  অধিকারী।

             ২০  নং  রানি  রাসমণি  রোডে  অবস্থিত  বাড়িটি  জগদম্বার  অন্য  তিন  ছেলে  উত্তরাধিকারী  সূত্রে  পান।  তাই  এখন  বিশ্বাস  বংশ  এই  বাড়ির  অধিকারী।

          কুমারীর  স্বামী  প্যারিমোহন  চৌধুরী।  ১৮/৩এ,  এস. এন. ব্যানার্জী  রোডের  বাড়িটি  এখন  প্যারিমোহনের  বংশধরদের  অধিকারে।  পদ্মমণির  অংশে  কোন  পুজো  হয়  না।  
             
 ২০  নং  রানি  রাসমণি  রোডে  অবস্থিত  ঠাকুর  দালান  ও  দুর্গা  প্রতিমার  ছবি ( ২০১৫ সালে  তোলা ) :
ঠাকুর  দালান

প্রতিমা - ১

প্রতিমা - ২
 ১৩ নং  রানি  রাসমণি  রোডে  অবস্থিত  ঠাকুর  দালান  ও  দুর্গাপ্রতিমার  ছবি ( ২০১৫  সালে  তোলা ) :
ঠাকুর  দালান  ( বাহির ) 

ঠাকুর  দালান ( ভিতর )

প্রতিমা 

১৮/৩ এ,  এস.  এন.  ব্যানার্জি  রোডে  অবস্থিত  ঠাকুর  দালান  ও   দুর্গা  প্রতিমার  ছবি ( ২০১৭ সালে  তোলা ) :
ঠাকুর  দালান

প্রতিমা - ১

প্রতিমা - ২


সহায়ক  গ্রন্থাবলী :
                 ১) দ্বাদশ  নারী :  দুর্গাদাস  শর্মা 
                 ২) জীবনী  সমগ্র  ( ২য়  ভাগ ) :  গণেশচন্দ্র  মুখোপাধ্যায় 

 *******

অন্যান্য  বনেদি  বাড়ির  পুজো  দেখতে  নিচের  লিংকে  ক্লিক  করুন :






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন